কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার, কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়

12

মানবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গের নাম কিডনি (Kidney) বাংলায় যাকে বলে বৃক্ক। দেখতে দুটি শিমের আকৃতির মত। কিডনি আকারে এক একটি আমাদের হাতের মুষ্টির মত। মানুষের মেরুদণ্ডের প্রতিটি পাশে একটি করে পাঁজরের খাঁচার নীচে অবস্থিত, যার প্রধান কাজ হচ্ছে শরীরের রক্তকে পরিশোধিত করে প্রস্রাবের মাধ্যমে বর্জ্য অপসারণ করা। কোন কারণে কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়লে শরীরে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই আজ আমরা এই কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করবো। আলোচনা থেকে আপনার কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায় সম্পর্কে জানতে পারবেন। আরও জানতে পারবেন কিভাবে কিডনি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসার মাধ্যমে নিজেকে সুস্থ্য করে তুলবেন। তাহলে চলুন বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

কিডনি রোগের কারণঃ

প্রতিদিন গড়ে ২ টি কিডনি আমাদের শরীরের ২০০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে এবং রক্ত থেকে বর্জ্য নিঃসরণ করে থাকে। যে সকল কারণে কিডনি অকার্যকর হয়ে পড়ে বা তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সেই গুলিই হচ্ছে কিডনি অসুখ। অসুস্থ বা অকার্যকর কিডনি মানুষের শরীরে দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক অসুস্থতা সৃষ্টি করে যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি ধুকে ধুকে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাই কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানা থাকলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় করে সুস্থ্য থাকা যায়। যে সকল কারণে কিডনি অসুস্থ হয়ে থাকে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

  • টাইপ ১ বা টাইপ ২ ডায়াবেটিস
  • উচ্চ রক্তচাপ
  • পলিসিস্টিক কিডনি রোগ বা অন্যান্য উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত কিডনি রোগ
  • গ্লোমেরুলোনফ্রাইটিস (গ্লোভ-মেরু-লো-নুহ-ফ্রাই-টিস), কিডনির ফিল্টারিং ইউনিটের প্রদাহ (গ্লোমেরুলি)
  • বর্ধিত প্রস্টেট, কিডনিতে পাথর এবং কিছু ক্যান্সারের মতো অবস্থা থেকে মূত্রনালীতে দীর্ঘস্থায়ী বাধা
  • ভেসিকোরেটেরাল(ves-ih-koe-yoo-REE-tur-ul) রিফ্লাক্স, এমন একটি অবস্থা যার ফলে প্রস্রাব পুনরায় কিডনিতে ফিরে যায়
  • বারবার কিডনি সংক্রমণ, যাকে পাইলোনেফ্রাইটিসও বলা হয় (pie-uh-low-nuh-FRY-tis)
  • জন্মগত কিডনি এবং মূত্রনালীর অস্বাভাবিকতা
  • অটোইমুউন রোগ (Autoimmune diseases) প্রভৃতি।

যাদের কিডনি রোগের ঝুকি বেশিঃ

অনেক সময় কিডনি রোগে প্রাথমিক অবস্থায় কোন উপসর্গ দেখায় না। যে কেউ যেকোনো বয়সে ক্রনিক কিডনি রোগে আক্রান্ত হতে পারে। যাইহোক, কিছু লোকের কিডনি রোগ হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় বেশি। আপনার কিডনি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে যদি আপনার:

  • ডায়েবেটিস থেকে থাকে
  • উচ্চ রক্তচাপ থেকে থাকে
  • হার্টের (কার্ডিওভাসকুলার) রোগে আক্রান্ত
  • পরিবারে কারো যদি কিডনি রোগের ইতিহাস থেকে থাকে
  • বয়স যদি ৪০ ঊর্ধ্ব হয়ে থাকে 
  • ধূমপান
  • স্থুলতা বা শরীরে অতিরিক্ত ওজন 
  • কোন অসুস্থতার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে ওষুধ সেবনকারী এবং
  • আফ্রিকান আমেরিকান, হিস্পানিক আমেরিকান, এশিয়ান, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপবাসী এবং আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের মতো উচ্চ হারে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত কোন একটি জনসংখ্যা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন।
Human-Kidney-Anatomy-by-drsaymarezoyana.com
Human-Kidney-Anatomy-Designed by brgfx / Freepik

কিডনি রোগের লক্ষণ:

কিডনি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে তেমন কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না।  ধীরে ধীরে কিডনির কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকলে লক্ষণগুলো দেখা দিতে শুরু করে। কোন কারণে শরীরের রুটিন পরীক্ষা, যেমন রক্ত ​​বা প্রস্রাব পরীক্ষা করা হলে প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগের সম্ভাব্য সমস্যা সনাক্ত করা সম্ভব হয় এবং চিকিৎসায় ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। তবে পরবর্তী পর্যায়েই মূলত রোগের  লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়, যার মধ্যে রয়েছে-

  • ওজন হ্রাস ও ক্ষুধা হ্রাস
  • ফোলা গোড়ালি, পা বা হাতে পানি এসে ফোলা ভাব (oedema)
  • প্রস্রাবের সাথে রক্ত ​​যাওয়া
  • প্রস্রাবের প্রয়োজন বেড়ে যাওয়া (বিশেষ করে রাতে)
  • ঘনঘন প্রস্রাব হওয়া অথবা প্রস্রাব কমে যাওয়া দুটোই কিডনির সমস্যার লক্ষণ। শরীর থেকে পানি বের করা ছাড়াও পানি শুষে নেয়ার কাজও করে কিডনি। সেটি করতে না পারলে বেশি প্রস্রাব হয়ে থাকে। প্রস্রাবের রঙ লালচে হলে, প্রস্রাবে ফেনা ভাব হলে। কিডনিতে পাথর, ক্যান্সার, টিউমারের কারণে প্রস্রাবের সাথে রক্ত যেতে পারে। কিডনি’র সমস্যা হলে শরীর থেকে প্রোটিন বেশি বের হয়ে যায় তাই ফেনা ভাব হয়।
  • শ্বাসকষ্ট
  • ক্লান্তি
  • ঘুমাতে অসুবিধা (অনিদ্রা)
  • চামড়াতে চুলকানি, ত্বকের সমস্যা ও রঙ পরিবর্তন
  • পেশী বাধা বা টান লাগা (muscle cramps)
  • অসুস্থ বোধ করা
  • মাথা ব্যাথা
  • পুরুষদের মধ্যে ইরেক্টাইল ডিসফাংশন

উপরোক্ত লক্ষণ গুলি দেখা দিলে কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। কিডনি রোগের এই পর্যায়ে কিডনি ফেইলার বা মূত্রাশয় – সম্বন্ধীয় ব্যাধি দেখা দেয় যা নিরাময়ে শেষ পর্যন্ত ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপনের মত চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।

কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়ঃ

কিডনি ভালো আছে কিনা সেটা খালি চোখে দেখে বোঝার তেমন কোন উপায় নাই। এছাড়া কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে কোন লক্ষণও প্রকাশ পায়না। কিডনি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হবার পরই সাধারন লক্ষণ গুলি প্রকাশ পেয়ে থাকে। তাই যাদের কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার ঝুকি বেশি রয়েছে, যেমন- উচ্চরক্ত চাপ ও ডায়েবেটিসে আক্রান্ত রোগী, পরিবারে যাদের কিডনি রোগের ইতিহাস রয়েছে, যাদের ৬০ বছরের বেশি বয়স তাদের উচিৎ বছরে অন্তত ২ বার দুটো পরীক্ষা করানো। আপনার কিডনি ঠিকমত কাজ করছে কিনা তা জানতে ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন ACR(প্রস্রাবের পরীক্ষা) ও GFR(রক্তের পরীক্ষা)-এই দুটি সাধারন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকে।

কিডনি ভালো আছে কিনা সেটা খালি চোখে দেখে বোঝার তেমন কোন উপায় নাই। এছাড়া কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে কোন লক্ষণও প্রকাশ পায়না। কিডনি অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হবার পরই সাধারন লক্ষণ গুলি প্রকাশ পেয়ে থাকে।

An illustration of the anatomy of a healthy and diseased kidney.

ছবিঃ সুস্থ্য ও অসুস্থ্য কিডনির ছবি

তাই যাদের কিডনি রোগে আক্রান্ত হবার ঝুকি বেশি রয়েছে, যেমন- উচ্চরক্ত চাপ ও ডায়েবেটিসে আক্রান্ত রোগী, পরিবারে যাদের কিডনি রোগের ইতিহাস রয়েছে, যাদের ৬০ বছরের বেশি বয়স তাদের উচিৎ বছরে অন্তত ২ বার দুটো পরীক্ষা করানো। আপনার কিডনি ঠিকমত কাজ করছে কিনা তা জানতে ন্যাশনাল কিডনি ফাউন্ডেশন ACR(প্রস্রাবের পরীক্ষা) ও GFR(রক্তের পরীক্ষা)-এই দুটি সাধারন পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়ে থাকে।

১। রক্ত পরীক্ষাঃ 

কিডনি রোগের প্রধান পরীক্ষা হল রক্ত ​​পরীক্ষা। পরীক্ষাটি আপনার রক্তে ক্রিয়েটিনিন নামক বর্জ্য পদার্থের মাত্রা পরিমাপ করে।

আপনার কিডনি এক মিনিটে কত মিলিলিটার বর্জ্য ফিল্টার করতে সক্ষম হবে তা গণনা করতে একজন ডাক্তার আপনার রক্ত ​​​​পরীক্ষার ফলাফল এবং আপনার বয়স, আকার, লিঙ্গ এবং জাতিগত গোষ্ঠীর তথ্য ব্যবহার করে।

এই গণনাটি আপনার আনুমানিক গ্লোমেরুলার পরিস্রাবণ হার (eGFR) হিসাবে পরিচিত।

সুস্থ কিডনি ৯০ মিঃলিঃ/মিঃ এর বেশি ফিল্টার করতে সক্ষম হওয়া উচিত। আপনার হার এর চেয়ে কম হলে আপনার ক্রনিক কিডনি ডিজিস (CKD) থাকতে পারে।

২। প্রস্রাব পরীক্ষাঃ

এছাড়াও প্রস্রাব বা ACR পরীক্ষায় আপনার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন ও ক্রিয়েটিনিনের অনুপাত যাচাই করা হয়। যদি মূত্র পরীক্ষায় প্রোটিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়, তার মানে দাঁড়ায়, কিডনি ঠিকমত রক্তকে ছাঁকতে পারছে না। তখন নিশ্চিত হতে তাঁর NFR করাতে হয়। তিন মাস বা তার বেশি সময় ধরে যদি রেজাল্ট পজিটিভ হয়, তাহলে কিডনি অসুস্থের লক্ষণ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়।

এ থেকে কিডনি কতটা ভাল কাজ করছে তার একটি সঠিক চিত্র পাওয়া যায়।

৩। অন্যান্ন পরীক্ষাঃ

কখনও কখনও অন্যান্য পরীক্ষায় আপনার কিডনির ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করতে ব্যবহৃত হয়। এর ভিতর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে:

একটি আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান, এমআরআই স্ক্যান বা সিটি স্ক্যান – কিডনি দেখতে কেমন এবং কোন ব্লকেজ আছে কিনা তা দেখতে একটি কিডনি বায়োপসি – কিডনি টিস্যুর একটি ছোট নমুনা সংগ্রহ করা হয় এবং ক্ষতির লক্ষণগুলির জন্য কোষগুলি একটি মাইক্রোস্কোপের নীচে পরীক্ষা করা হয়।

তাই কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার জন্য এই পরীক্ষা গুলি করা যেতে পারে। পূর্বেই বলেছি যে, খালি চোখে কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝা সম্ভব নয় তাই এই পন্থা গুলিই মূলত কিডনি ভালো আছে কিনা বোঝার উপায়

কিডনি রোগের ঝুকি পরিমাপ করতে এই লিংকে যানঃ এখানে ক্লিক করুণ

কিডনি রোগ প্রতিরোধে করনীয়ঃ

কথায় আছে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই শ্রেয়। একবার কিডনি রোগাক্রান্ত হয়ে গেলে আর ভোগান্তির শেষ নাই। কারণ কিডনি রোগ যেমন জটিল তেমনি এর চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। তাই কিডনি সুস্থ্য থাকতে এর যত্ন নেওয়া জরুরী।

কিডনি যে কেবল শরীরের রক্ত শোধন বা বজ্য নিষ্কাশনই করে তাই নয়; এর পাশাপাশি রক্তকণিকা তৈরি, হাড়ের সুস্থতা, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, পানি ও লবণের ভারসাম্য রক্ষাসহ শরীরের আরও নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকে। তাই কিডনি নষ্ট হলে শরীরের সার্বিক ব্যবস্থাপনার উপর এর প্রভাব পড়ে থাকে।

অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ হচ্ছে কিডনি বিকল হওয়ার প্রধান দুইটি কারণ। এছাড়া শিশুদের ক্ষেত্রে গ্লোমেরুলোনেফ্রাটিস, কিডনিতে পাথর, ক্যানসার, নানা ওষুধ ও রাসায়নিকের বিষক্রিয়া প্রভৃতি কারণে কিডনি বিকল হয়ে থাকে। কিন্তু একটু সচেতন থেকেই কিডনি রোগ থেকে সহজে বেঁচে থাকা যায়। 

এক. যেহেতু অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ কিডনি বিকল করে দিতে পারে। তাই পরিবারে যাদের বয়স ৪০ পেরিয়েছে, তাদের নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন, রক্তচাপ বেশি থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন। খাবার পাতে লবণ খাওয়ার অভ্যাস পরিহার করুণ। রক্তচাপ একটু বেশি থাকলে কিছু হয় না বা সমস্যা নাই, হলে ওষুধ খাবার দরকার নেই- এই ধরণের ভ্রান্ত ধারনা থেকে বেরিয়ে আসুন। বয়স্করা অনেক সময় ওষুধ খেতে ভুলে যান, বা রক্তচাপ বাড়লেও বুঝতে পারেন না। তাই তাদের দিকে বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন।

দুই. বাংলাদেশে কিডনি বিকল হওয়ার প্রধানতম কারণ হচ্ছে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস। যাদের ডায়াবেটিস আছে, তারা বছরে অন্তত এক বা দুবার কিডনি পরীক্ষা করাবেন। মনে রাখবেন, ডায়াবেটিস যেকোন বয়সে যে কারোরই হতে পারে। তাই নিয়মিত রক্তের শর্করা মাপুন এবং রক্তে শর্করার মাত্রা কাঙ্খিত মাত্রার নিচে রাখন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

তিন. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খেয়াল খুশি মত যখন-তখন দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাবেন না। অনেক ওষুধ আছে যা কিডনির জন্য ক্ষতিকর। অনেক ওষুধ আছে যা মাত্রাতিরিক্ত হলে কিডনির সমস্যা হতে পারে। হারবাল, বনাজি ওষুধ, অতিরিক্ত ভিটামিন, ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্টও কিডনির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। শিশুদের যেকোনো ওষুধ খায়ানোর পূর্বে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। তাই সাবধান, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ কে না বলুন।

চার. স্থুলতার সাথে কিডনি রোগের সম্পর্ক রয়েছে। তাই ২০১৭ সালের কিডনি দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল অধিক ওজন ও কিডনি রোগ। গবেষণায় দেখা গেছে কিডনিতে পাথর, ক্যানসার ও দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগের সঙ্গে স্থুলতার সম্পর্ক রয়েছে। তাছাড়া ওজন বাড়লে ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। তাই প্রত্যেকের উচিৎ নিয়মিত ব্যায়াম করা ও ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা। তাহলে আপনার অনেক রোগের মতো কিডনি রোগের ঝুঁকিও কমবে।

পাঁচ. সুস্থ্য জীবনের জন্য পরিবারে সুষম খাদ্যা গ্রহণের অভ্যাস গড়ে তোলা জরুরী। শরীরকে সক্রিয় রাখতে নিয়মিত প্রচুর শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে হবে। অতিরিক্ত মাত্রায় লাল মাংস খাবেন না। সুস্থ্য অবস্থায় পর্যাপ্ত পানি পানের অভ্যাস গড়ে তুলুন। শিশুরা অনেক সময় স্কুলে ঠিকমতো পানি পান করে না। সেখান থেকে প্রস্রাপে ইনফেকশন হয়ে যায়। তাই তাদের দিকে আলদাভাবে খেয়াল রাখা জরুরী। অনেকেই আছেন প্রস্রাব আটকে রাখেন, বিশেষ করে মেয়েদের। এই কাজটি কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে। প্রস্রাবে সংক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে ব্যক্তিগত ও টয়লেটের পরিচ্ছন্নতার বজায় রাখা জরুরী।

ছয়. ধূমপান নানাবিধ অসুখের জন্ম দেয়। ধূমপান কিডনিতে রক্ত চলাচলে ব্যঘাত ঘটায়। কিডনি ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানের পরোক্ষ শিকারে শিশু ও নারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাই সুস্থ্য থাকতে ধূমপান ত্যাগ করা জরুরি।

সাত. বয়স বাড়লে প্রতিবছর নিয়মিত কিডনির সুস্থতা জানতে প্রস্রাবের আমিষ ও প্রয়োজনে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করান, বিশেষ করে আপনার যদি উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস থাকে তাহলে অবহেলা করবেন না। শরীরে কোনো ব্যতিক্রম লক্ষ্য করলে সতর্ক হোন। ছোটদেরও কিডনিতে প্রদাহ হয়ে থাকে। তাই প্রস্রাব কম হলে, লাল হলে ও শরীরে পানি জমা এর লক্ষণ দেখলে তাৎক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

আরও পড়ুনঃ দ্রুত ওজন কমানোর উপায়

কিডনিতে কি কি রোগ হয়ঃ

আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গোল্ড মেডেল প্রাপ্ত কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ রচিত “কিডনী রোগ চিকিৎসা ও প্রতিকার” শীর্ষক বইয়ের তথ্য মতে সচারচর কিডনীর যে সমস্ত রোগ দেখা যায়, তাকে ২ ভাগে বিভক্ত করা যেতে পারে-   

১। মেডিক্যাল সংক্রান্ত 

২। শল্য সংক্রান্ত

মেডিক্যাল সংক্রান্ত কিডনি রোগ সাধারণত ঔষধের ভালো হয়ে যায়। শল্য সংক্রান্ত কিডনি রোগে সুস্থ্যতার জন্য অপারেশনের প্রয়োজন পড়ে।

 ১। মেডিক্যাল সংক্রান্ত কিডনী রোগ সমূহঃ

  • কিডনীর ছাঁকনির রোগ বা নেফ্রাইটিস
  • প্রস্রাবের প্রদাহ বা ইনফেকশন
  • উচ্চরক্তচাপ জনিত কিডনী রোগ
  • ডায়েবেটিস জনিত কিডনী রোগ 
  • হৃদরোগ জনিত কিডনী রোগ
  • আকস্মিক কিডনী বিকল রোগ 
  • ধীর গতিতে কিডনী বিকল রোগ
  • গর্ভাবস্থায় কিডনী রোগ 
  • ঔষধের ব্যবহার জনিত কিডনী রোগ
  • বংশানুক্রমিক কিডনী রোগ

২। শল্য সংক্রান্ত

  • পাথর জনিত কিডনী রোগ
  • জন্মগত কিডনী রোগ
  • প্রস্টেট গ্লান্ডের জটিলতায় কিডনী রোগ
  • কিডনীর সিস্ট এবং টিউমার

কিডনী বিকল রোগের চিকিৎসায় ডায়ালাইসিস গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকে। এছাড়া কিডনি ড্যামেজ ও পুরোপুরি অকেজো হলে অপারেশনের মাধ্যমে কিডনী প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে।  

তাই নিজেকে সুস্থ্য রাখতে কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জেনে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ সনাক্ত করা গেলে সহজে এই রোগ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব অন্যথায় কিডনি রোগ হতে পারে মৃত্যুর কারণ।

কিডনি ব্যাথার লক্ষণঃ

আমাদের দেশের অনেক রোগীরাই কোমরব্যথা হলেই ভাবেন আমার বোধ হয়  কিডনিতে সমস্যা হয়েছে।কিডনিতে পাথর বা খারাপ কোন ধরনের সংক্রমণ না হওয়া পর্যন্ত কিডনিতে ব্যথা অনুভূত হয় না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মাহবুব মোর্শেদ কে এ বিষয়ে  জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, কোনো রকম ব্যথা-বেদনা ছাড়াও কিডনি খারাপ হতে পারে। কারণ, কিডনি সমস্যার উপসর্গ সাধারণত দেরিতে দেখা দেয়। তাই যাদের পরিবারে কিডনির অসুখ আছে, তাদের বেশি সচেতন থাকা উচিত। আর সাধারণ কোমরব্যথায় সাধারণত জ্বর হয় না (তবে টিউমার, টিবি ইত্যাদি ছাড়া)। দুর্বলতা, রক্তশূন্যতা, অরুচি, বমির ভাব ইত্যাদি আনুষঙ্গিক সমস্যা সাধারণত থাকে না। বিশ্রাম ও ব্যথানাশক ওষুধ সেবনে ভালো হয়; বন্ধ করলে ব্যথা আবার ফিরে আসে।

কিডনিজনিত ব্যথা সাধারণত মেরুদণ্ড থেকে একটু দূরে ডান বা বাম পাশে হয়। এটি পেছনের পাঁজরের নিচের অংশে অনুভূত হয়ে থাকে। এই ব্যথা নড়াচড়া করে এবং কোমরের দুই পাশেও যেতে পারে। এই ব্যথা থেকে থেকে আসে, শোয়া-বসা বা কোনো কিছুতেই আরাম মেলে না। l কিডনি সমস্যায় ব্যথা প্রধান উপসর্গ নয়, এতে শরীরে পানি আসা, অনিদ্রা, অরুচি, দুর্বলতা, বমি বমি ভাব দেখা দেয়। l সংক্রমণ হলে এই ব্যথার সাথে জ্বর হতে পারে। l প্রস্রাব ঘোলাটে হয়, দুর্গন্ধ বা রক্ত থাকতে পারে। l প্রস্রাবের পরিমাণ কম-বেশি হয়। রক্তশূন্যতা থাকতে পারে।

কিডনি ইনফেকশনের লক্ষণঃ

কিডনি সংক্রমণ হল এক ধরনের মূত্রনালীর সংক্রমণ (ইউটিআই)। শরীর (মূত্রনালী) বা মূত্রাশয় থেকে প্রস্রাব বহনকারী নলটি থেকে কিডনির সংক্রমণ শুরু হতে পারে। সংক্রমণ এক বা উভয় কিডনিতে যেতে পারে। কিডনির সংক্রমণকে পাইলোনেফ্রাইটিসও বলা হয়। 

কিডনির সংক্রমণ দ্রুত চিকিৎসা প্রয়োজন। সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হলে, এটি কিডনির দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি করতে পারে এমন কি ব্যাকটেরিয়া রক্তের প্রবাহে ছড়িয়ে পড়তে পারে যা একটি বিপজ্জনক সংক্রমণ ঘটাতে পারে।

কিডনি সংক্রমণের লক্ষণগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ

  • জ্বর 
  • ঠাণ্ডা 
  • প্রস্রাব করার সময় জ্বলন্ত অনুভূতি বা ব্যথা 
  • ঘনঘন  প্রস্রাব 
  • প্রস্রাব করার জন্য একটি শক্তিশালী, দীর্ঘস্থায়ী তাগিদ 
  • পিঠে, পাশে বা কুঁচকিতে ব্যথা 
  • বমি বমি ভাব এবং বমি 
  • প্রস্রাবে পুঁজ বা রক্ত 
  • প্রস্রাবে দুর্গন্ধ বা ঘোলাটে
  • পেট ব্যথা

কিডনি ফেইলিওর এর লক্ষণঃ

যখন আপনার কিডনি হঠাৎ আপনার রক্ত ​​থেকে বর্জ্য পদার্থ ফিল্টার করতে অক্ষম হয়ে যায় সেই অবস্থাকে কিডনি ফেইলর বলে। এই পরিস্থিতিতে কিডনি তাদের ফিল্টার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তখন শরীরে বিপজ্জনক মাত্রায় বর্জ্য জমা হতে পারে এবং আপনার রক্তের রাসায়নিকের ভারসাম্য ব্যহত হয়। কিডনি ফেইলরের ফলে নিম্নোক্ত লক্ষণগুলো দেখা দিয়ে থাকে;

  • প্রস্রাবের আউটপুট হ্রাস, যদিও মাঝে মাঝে প্রস্রাব আউটপুট স্বাভাবিক থাকে
  • শরীরে পানি জমে ফোলা ভাব দেখা দেয়। আপনার পা, গোড়ালি বা পায়ে ফোলা সৃষ্টি করে
  • শ্বাস কষ্ট দেখা দেয়
  • ক্লান্তি 
  • বিভ্রান্তি ও ঘুম ঘুম ভাব
  • বমি বমি ভাব 
  • দুর্বলতা
  • অনিয়মিত হৃদস্পন্দন
  • বুকে ব্যথা বা চাপ অনুভূত হয়
  • গুরুতর ক্ষেত্রে খিঁচুনি বা রোগী কোমায় চলে যেতে পারে

কখনও কখনও কিডনি ফেইলরের কোনও লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয় না এবং অন্য কারণে ল্যাব পরীক্ষার সময়ে কিডনি ফেইলর সনাক্ত হয়।

কিডনি রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাঃ

কিডনি রোগ নির্ণয়ে বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়ে থাকে, যা যেকোন ল্যাবরেটরিতেই করানো সম্ভব। এ সকল পরীক্ষার মধ্যে রয়েছে- রক্ত পরীক্ষা, প্রস্রাবের পরীক্ষা ও আলট্রাসনোগ্রাফির মত পরীক্ষা। তবে এক এক পর্যায়ের অবস্থা যাচাইয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন বা প্রয়োজনে এক সবগুলো পরীক্ষা এক সাথে করার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করছি।

১। প্রস্রাবে আমিষ বা অ্যালবুমিন নির্গত হওয়া কিডনি রোগের অন্যতম লক্ষণ। রোগীর প্রস্রাবের রুটিন মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষার মাধ্যমে এই তথ্য জানা যায়। অনেক সময় এর পরিমাণ এত কম যে সাধারণ রুটিন প্রস্রাব পরীক্ষায় ধরা নাও পড়তে পারে সেই ক্ষেত্রে মাইক্রো অ্যালবুমিন টেস্ট করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে চিকিৎসক নিশ্চিত হতে প্রয়োজনে ২৪ ঘণ্টার জমানো প্রস্রাবে আমিষের পরিমাণ পরীক্ষা করে থাকেন। 

২। রক্তে ইউরিয়া ও সিরাম ক্রিয়েটিনিনের মাত্রা পরীক্ষার মাধ্যমেও কিডনির সক্ষমতা বুঝা যায়। কিডনি অকার্যকর হলে এ দুটির মাত্রা বেড়ে যায়। 

৩। কিডনি কতখানি আক্রান্ত, তা সবচেয়ে ভালো বোঝা যায় জিএফআর (গ্লোমেরুলার ফিলট্রেশন রেট) বা সিসিআর (ক্রিয়েটিনিন ক্লিয়ারেন্স রেট) টেস্ট করে। জিএফআর ৯০–এর ওপর হলে দুশ্চিন্তার কিছু নাই। আর ১৫-এর নিচে নেমে গেলে কিডনি তার কার্যক্ষমতার শেষ পর্যায়ে রয়েছে।

কিডনির কতো ভাগ কার্যক্ষম রয়েছে, তার উপর ভিত্তি করে কিডনি রোগীকে পাঁচটি পর্যায়ে বা স্টেজ-এ ভাগ করা যায়।

  • যাদের কিডনি কার্যকারিতা ৯০ ভাগের ওপরে -১ম পর্যায়
  • কিডনির কার্যকারিতা ৬০-৮৯ ভাগ- ২য় পর্যায় 
  • ৩০-৫৯ ভাগ কার্যক্ষম- ৩য় পর্যায়
  • ১৫-২৯ ভাগ- ৪র্থ পর্যায়
  • যাদের কিডনির কার্যকারিতা ১৫ ভাগের নিচে-৫ম পর্যায়।

যারা এই পঞ্চম পর্যায়ের রোগী তাদের একমাত্র চিকিৎসা হচ্ছে ডায়ালাইসিস বা কিডনি প্রতিস্থাপন করা। এইজন্যেই রক্তের ক্রিয়েটিনিন থেকে এই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগী কোন পর্যায়ে আছে তা বের করে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা করালে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা যেতে পারে। প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় পর্যায়ের রোগীরাও চিকিৎসার ফলে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। ৪র্থ পর্যায়ের রোগীদের পুরোপুরি নিরাময় না করা গেলেও কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব। কাজেই এই পরীক্ষাগুলো রোগ শনাক্ত করে তা প্রতিরোধ করতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪। কিডনির আকার, পাথর, টিউমার, সিস্ট, মূত্রতন্ত্র, প্রোস্টেটের অবস্থা ইত্যাদি বুঝতে আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা একটি কার্যকর রিপোর্ট প্রদানে সক্ষম। 

৫। কিডনি ফেইলিউরে আনুষঙ্গিক জটিলতা নির্ণয়ে রক্তের হিমোগ্লোবিন, ইলেকট্রোলাইট, ক্যালসিয়াম, ফসফেট, ভিটামিন ডি ইত্যাদি পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে। রোগ নির্ণয়ে প্রত্যেকেরই নিয়মিত রক্তের শর্করা ও রক্তচাপ মাপা উচিৎ।

সুস্থ্য থাকতে পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকারে সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ অতিব জরুরী।

কিডনি রোগে কি খাবেন কি খাবেন না জানতে পড়ে দেখুন।

কিডনি রোগ কি ভাল হয়?

কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কিত আলোচনা থেকে এটা প্রতীয়মান হয় যে, কিডনি রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ্য হওয়া যায় তবে আপনার কিডনির কার্যক্ষমতা যদি ১৫ ভাগের নিচে নেমে যায় সেক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস ও কিডনি প্রতিস্থাপনই একমাত্র চিকিৎসা। যেহেতু প্রাথমিক পর্যায়ে কিডনি রোগে তেমন কোন লক্ষণ প্রকাশ পায় না তাই কিডনির অবস্থা জানতে নিয়মিত চেকাপ করা জরুরী। বিশেষ করে আপনার যদি ডায়েবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের মত ব্যাধি থেকে থাকে বা হুট করে শরীরে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। তাহলে কিডনির অবস্থা জানতে পরীক্ষা করা উচিৎ। যেহেতু দীর্ঘ মেয়াদী কিডনি রোগের চিকিৎসা যথেষ্ট কষ্টকর ও ব্যায় সাপেক্ষ বিধায় পূর্ব থেকে সচেতন থাকা ও স্বাস্থ্য সম্মত জীবনযাবন পারে আপনাকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে।

কিডনি রোগের প্রতিকার বা চিকিৎসাঃ

কিডনি রোগের প্রতিকারে একজন নেফ্রোলজি বিশেষজ্ঞের পরামর্শে ঔষধ গ্রহণ করা জরুরী। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ওষুধ সেবনই পারে আপনাকে সুস্থ্য করে তুলতে।

উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস হচ্ছে কিডনি রোগের প্রধান দুইটি ঝুঁকির কারণ। তাই যারা দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস এবং উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত তাদের উচিৎ নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ও ওষুধ সেবন করা। অন্যথায় যেকোন সময় তাদের কিডনি অসুস্থ হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। খেয়াল রাখতে হবে যেন ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ যেন সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে। 

নিজেকে সুস্থ্য রাখতে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করতে হবে। জটিল কিডনি সমস্যা না থাকলে ডাক্তারের পরামর্শে সপ্তাহে ৫ দিন অন্তত ৩০ মিনিট এক্সারসাইজ করতে পারেন।

শরীরে অতিরিক্ত ওজন থাকলে দ্রুত ওজন কমিয়ে ফেলতে হবে।

ধূমপান থেকে নানা রকম ব্যাধির সৃষ্টি হয়ে থাকে তাই এখনই ধূমপানকে না বলুন। সিগারেট, ফাস্টফুড, জর্দা, তামাক, এলকোহল গ্রহণ ইত্যাদি বদভ্যাস পরিহার করতে হবে।

খাবার পাতে অতিরিক্ত লবণ খাওয়ার অভ্যাস কিডনিকে ক্ষতি করে থাকে তাই এই অভ্যাস ত্যাগ করা প্রয়োজন। 

নিয়মিত বেশি বেশি শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। তবে যাদের কিডনি রোগ আছে, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে ফলমূল খাওয়া যাবে না। 

রক্তে কলস্টেরলের মাত্রা সবসময় স্বাভাবিক পর্যায়ে রাখতে হবে। 

ব্যথানাশক ঔষধ সেবনে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

রাতে কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।

যারা ইতিমধ্যে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে নিয়মিত ওষুধ সেবন এবং রুটিন চেকআপ করানো অত্যাবশ্যক।

যাদের কিডনির কার্যক্ষমতা ২৯ ভাগের নিচে তাদের ক্ষেত্রে ডায়ালাইসিস ও সার্জারির মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে।

কিডনি রোগের ঘরোয়া চিকিৎসাঃ

কিডনিতে নানা ধরণের রোগ হয়ে থাকে। এক এক ধরণের কিডনি অসুখের জন্য প্রয়োজন এক এক ধরণের ঘরোয়া চিকিৎসা। যেমন-

  • একজন সুস্থ্য ব্যক্তির দৈনিক গড়ে ২-৩ লিটার পানি পান প্রয়োজন। কিডনিতে পাথর হলে প্রচুর পানি পান সেই পাথর অপসারণে সাহায্য করে থাকে। খুব ছোট আকারের পাথর দেখা দিলে পরিমাণমতো পানি পানের মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলা সম্ভব। এছাড়া প্রসাবে বা কিডনিতে ইনফেকশন ভালো করতে বেশি বেশি পানি পান বেশ কার্যকর ভুমিকা রাখে। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। কারণ কিছু কিছু কিডনি রোগে অতিরিক্ত পানি পান ক্ষতিকর হতে পারে। বিশেষ করে আপনার শরীরে যদি পানি জমে থাকে, শরীর পানিতে ফুলে গিয়ে থাকে সেই ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পানি পান করা যাবে না।
  • কিডনির পাথরকে ভেঙে ফেলতে তুলসী পাতায় থাকা অ্যাসিটিক অ্যাসিড বেশ কার্যকর। তাই প্রতিদিন অন্তত দুইবার তুলসীর রস খেলে উপকার পাওয়া যায়। অনেকে চায়ে তুলসীর পাতা দিয়ে পান করে থাকেন।
  • পাতিলেবুর রসে থাকা সাইট্রিক অ্যাসিড ক্যালসিয়ামজাত পাথর তৈরিতে বাধা প্রদান করে এবং ছোট পাথরগুলোকে ভেঙে বের করে দেয়। তাই কিডনি পাথর অপসারণে প্রতিদিন সকালে পানির সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে পান করুন অথবা দিনের অন্য সময়ে লেবুর রস পান করুন।
  • ডালিমের রসে থাকা অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট কিডনিকে সুস্থ রাখতে এবং পাথর ও অন্যান্য টক্সিনকে দূর করতে সাহায্য করে। তবে সারা দিনে কি পরিমাণ ডালিমের রস গ্রহণ করবেন তা চিকিৎসকের সাথে পরামর্শ করে নিন।
  • এক চামচ আপেল সিডার ভিনিগারের সঙ্গে দুই টেবিল চামচ পানি মিশিয়ে পান করুন। আপেল সিডার ভিনিগারে থাকা অ্যাসিটিক অ্যাসিড কিডনিতে থাকা পাথর দূর করতে এবং ব্যথা কমাতেও সাহায্য করে। তবে একদিনে ১৬ চামচের বেশি খাবেন না।
  • এক কাপ ফোটানো জলে ১ থেকে ২ চা চামচ শুকনো মেথি বীজ ভিজিয়ে রেখে প্রতিদিন পান করুন। মেথি বীজ কিডনির পাথর প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, মেথী বীজ কিডনিতে জমে থাকা পাথর হ্রাস করে ও কিডনিতে পাথর জমা প্রতিরোধ করে।
  • ২৫০ এমএল গরম পানিতে হাফ চা চামচ শুকনো কালিজিরা বীজ দিয়ে দিনে দু’বার পান করুন। কারণ একটি গবেষণা অনুযায়ী, কালিজিরার বীজ কিডনিতে ক্যালসিয়াম অক্সালেট স্টোন গঠনে উল্লেখযোগ্যভাবে বাধা দেয়।
  • কিডনির স্বাস্থ্য উন্নত করতে ক্র্যানবেরি জুস পান কার্যকর। যদিও কিছু বিশেষজ্ঞদের মধ্যে এ বিষয়ে বিতর্কিত রয়েছে। যাইহোক, কিছু গবেষণা এই ধারণাটিকে সমর্থন করে যে ক্র্যানবেরি জুস ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কমাতে সাহায্য করতে পারে যখন একজন ব্যক্তির প্রস্রাবে ইনফেকশন থাকে।
  • পর্যাপ্ত পরিমাণ বিশ্রাম নিন। কিডনি সংক্রমণের (ইনফেকশন) পর প্রচুর পরিমাণ বিশ্রাম শরীরকে সুস্থ্য করতে সাহায্য করে।

তবে যেকোন চিকিৎসা গ্রহণের পূর্বে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নেওয়া জরুরী।

যে সকল ঔষধ তাৎক্ষণিক কিডনি অকেজো করতে পারেঃ

নানারকম অসুস্থতায় আমাদের কে হরেকরকম ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। কিন্তু আপনি জানেন কি কিছু ওষুধ তাৎক্ষণিকভাবে কিডনিকে অকেজো করে দিতে পারে। প্রধান প্রধান ওষুধ যা তাৎক্ষনিক কিডনি অকেজো করতে পারে, তার তালিকা নিম্নে প্রদান করছি- 

  • এন্টিবায়োটিকঃ  সিপ্রোফ্লক্সাসিন, মিথাইসিলিন, জেন্টামাইসিন, স্ট্রেপটমাইসিন, সালফোনামাইড, সেফালোসপোরিন, রিফামপিসিন।
  • ব্যাথানাশক ঔষধঃ নেফ্রোক্সিন, কক্সবি ইনহিবিটর, ডাইক্লোফেনাক।
  • এসি ইনহিবিটর ও এআরবই গ্রুপের ঔষধ।
  • গেস্ট্রিক আলসার নিরাময়ের ওষুধঃ অমিপ্রাজল, লেনসোপ্রাজল, পেন্ডাপ্রাজল।
  • আইভিইউ, রেনাল এনজিওগ্রাম, কার্ডিয়াক এনজিওগ্রাম অথবা সিটিস্ক্যান এর জন্য ব্যবহৃত ডাই।        

তাই যে কোন ওষুধ ব্যবহারের সময়ে তার পার্সপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে পূর্বে জেনে নিন এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেখে কোন ওষুধ গ্রহণ করবেন না।

কিডনি রোগের ঔষধের নামঃ

কিডনি রোগের চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞগণ রোগের কারণ সনাক্ত করে তা নিরাময়ে বেশি জোর দিয়ে থাকেন। রোগীর ডায়েবেটিস ও উচ্চরক্ত চাপ থাকলে প্রথমেই তা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। ডাক্তার রোগীর অবস্থা ভেদে নানা ধরণের ঔষধ দিয়ে থাকেন, যার মধ্যে আছে- Invokana(Canagliflozin), Farxiga (Dapagliflozin), Generic Phoslo (Calcium Acetate and Eliphos), Generic Renvela (Sevelamer Carbonate), Generic Sensipar (Cinacalcet), Procrit, Velphoro (Sucroferric Oxyhydroxide) প্রভৃতি। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যাতিরেখে কোন অবস্থায় কোন ধরণের ঔষধ গ্রহণ করা যাবে না।

হোমিয়প্যাথিক চিকিৎসায় কিডনি রোগের ঔষধঃ

কিডনি রোগের চিকিৎসায় হোমিয়প্যাথিতে বেশ কার্যকর কয়েকটি রেমিডি রয়েছে। যেমন- এপিস মেলিফিকা, আর্সেনিকাম, অরাম মুরিয়াটিকাম, বেলাডোনা, বেলাডোনা, ক‍্যান্থারিস, কোনাভ্যালারিয়া প্রভৃতি। রোগের ধরণ, লক্ষণ ও পর্যায় ভেদে এই ঔষধগুলি প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যাতিরেখে কোন অবস্থায় কোন ঔষধ গ্রহণ করা যাবে না। ঔষধের সঠিক মাত্রা ও প্রয়োগ বিধি জানতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকা জরুরী।

পরিশেষে,  কিডনি রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে যে আলোচনা করা হল তা থেকে এটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি হয়েছে যে, কিডনি রোগ ভীষণ মারাত্মক একটি রোগ। এই রোগকে কোন অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণের পাশাপাশি একটি যথাপযুক্ত আদর্শ জীবন ব্যবস্থার মাঝে নিজেকে পরিচালিত করে এই রোগ থেকে আরোগ্য ও সুস্থ্য থাকা সম্ভব।

তথ্যসুত্রঃ 

১। https://www.mayoclinic.org/diseases-conditions/chronic-kidney-disease/symptoms-causes/syc-20354521#:~:text=Diabetes%20is%20the%20most%20common,to%20long%2Dterm%20functional%20decline.

২। https://www.kidney.org/atoz/content/about-chronic-kidney-disease

৩। https://www.nhs.uk/conditions/kidney-disease/symptoms/

12 COMMENTS